৭.৪.১ লবণের রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য
এর আগে তোমরা জেনেছ যে লবণ হলো এসিড ও ক্ষারকের বিক্রিয়ায় উৎপন্ন পদার্থ। এখন তোমরা এর রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য জানবে।
কাজ: লবণের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা কর
প্রয়োজনীয় উপকরণ: ১টি পাত্র, খাবার লবণ, বিশুদ্ধ পানি, লাল ও নীল লিটমাস কাগজ, নাড়ানি।
পদভিঃ পারে ৫-১০ গ্রাম লবণ নিয়ে ৫ মিলিলিটার বিশুদ্ধ পানি যোগ কর। নাড়ানি দিয়ে ভালোভাবে নাড়া দিয়ে লবণের প্রবণ তৈরি কর। এবার একে একে লাল ও লিটমাস কাগজ যোগ করে দেখ এদের রং পরিবর্তন হয় কি না ।
লিটমাস কাগজের রং কি পরিবর্তন হলো? না, হলো না। এতে প্রমাণিত হলো যে লৰণ নিরপেক্ষ পদার্থ। তবে কিছু কিছু লবণের জলীয় দ্রবণ অম্লীয় বা ক্ষারীয় হতে পারে। যেমন: বেকিং সোডা (NaHCO·) বা খাবার সোডা। এটিও একটি লবণ, কিন্তু এর জলীয় দ্রবণ এসিডিক এবং এটি নীল লিটমাসকে লাল করে। এর কারণ হলো, যদিও এটি একটি লবণ কিন্তু পানিতে এটি হাইড্রোজেন আয়ন উৎপন্ন করে।
NaHCO3 - → Na+ + H+ + CO3 2 -
আবার সোডিয়াম কার্বোনেটের (Na, CO) জলীয় দ্রবণ ক্ষারীয় এবং সেটি লাল লিটমাসকে নীল করে। এর কারণ হলো, পানিতে সোডিয়াম কার্বোনেট, সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড ও কার্বোনিক এসিড তৈরি করে।
Na2CO3- NaOH + H2CO3
কিন্তু উৎপন্ন কার্বোনিক এসিড দুর্বল এসিড হওয়ায় তা পুরোপুরি বিয়োজিত হয় না, আংশিকভাবে বিয়োজিত হয়। পক্ষান্তরে সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড একটি শক্তিশালী ক্ষার বলে তা পুরোপুরি বিয়োজিত হয়ে হাইড্রোক্সাইড আয়ন তৈরি করে। ফলে দ্রবণে হাইড্রোক্সাইড আয়নের আধিক্য থাকে আর সে কারণেই দ্রবণটি ক্ষারীয় হয় এবং লাল লিটমাসকে নীল করে। কার্বোনেট লবলগুলো এসিডের সাথে বিক্রিয়া করে অন্য একটি লবণ, কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস ও পানি তৈরি করে। প্রায় সব লবণই কঠিন এবং গলনাংক ও স্ফুটনাংক তাপমাত্রা অনেক বেশি হয়। বেশির ভাগ লবণই পানিতে দ্রবণীয়, তবে কিছু কিছু লবণ আছে যারা পানিতে দ্রবীভূত হয় না। যেমন : ক্যালসিয়াম কার্বোনেট (CaCO3), সিলভার সালফেট (Ag2SO4), সিলভার ক্লোরাইড (AgCl)।
কাজ: ডিমের খোসা মূলত CaCO3 এবং এসিড দিয়ে এটাকে প্রবীভূত করা সম্ভব। একটি ডিম ভিনেগারে ডুবিয়ে রাখো এবং মাঝে মাঝে পরিষ্কার করে নতুন ভিনেগার দাও। দেখবে ডিমের শক্ত খোসা দ্রবীভূত হয়ে নরম তুলতুলে একটি ডিমে পরিণত হয়েছে।
৭.৪.২ লবণের ব্যবহার
লবণের ব্যবহারের কথা বলা হলে সবার আগে আমাদের খাবারের কথা চলে আসে। আমরা আমাদের খাবারে সব সময় লবণ ব্যবহার করি। লবণ ছাড়া তরকারি রান্না করলে সেটি ম্যাদহীন হবে এবং আমরা অনেকেই তা খেতে পারব না। যে লবণ আমাদের খাদ্যের স্বাদ বাড়িয়ে খাওয়ার উপযোগী করে তোলে, তা হলো সোডিয়াম ক্লোরাইড (NaCl), যা সাধরণ লবণ বা টেবিল লবণ নামেও পরিচিত। তরকারি ছাড়াও আরো অনেক খাবার, যেমন: পাউরুটি, আচার, চানাচুর ইত্যাদিতে খাবার লবণ ব্যবহার করা হয়। খাবারের স্বাদ বৃদ্ধি করার জন্য আরেকটি লবণ— সোডিয়াম গ্লুটামেট ব্যবহার করা হয়, যেটি 'টেস্টিং সল্ট' নামে পরিচিত।
আমরা কাপড় কাচার যে সাবান ব্যবহার করি তা হলো মূলত সোডিয়াম স্টিয়ারেট (C17H35COONa) আর শেভিং ফোম বা জেলে থাকে পটাশিয়াম স্টিয়ারেট (C17H35COOK)। কাপড় কাচার সোডা হিসেবে জামরা যে সোডিয়াম কার্বোনেট (Na2CO3) ব্যবহার করি তাও একটি লবণ। আবার আমরা জীবাণুনাশক হিসেবে যে তুঁতে (CuSO4.5H2O) বা ফিটকিরি [K2SO4. Al2(SO4)3.24H2O] ব্যবহার করি, সেগুলোও লবন ।
কৃষিতে লবণের ব্যবহার
তোমরা জান যে মাটির এসিডিটি নিষ্ক্রিয় করার জন্য আমরা যে চুনাপাথর ব্যবহার করি, এই চুনাপাথর একটি লবণ। আবার আমরা মাটির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য যে সার ব্যবহার করে থাকি, তাদের বেশির ভাগই হলো লৰণ। যেমন: অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট (NH 4 NO3), অ্যামোনিয়াম ফসফেট ((NH4)3PO4), পটাশিয়াম নাইট্রেট (KNO3) ইত্যাদি।তুঁতে বা কপার সালফেট (CuSO4) কৃষিজমিতে ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস প্রতিরোধে বহুল ব্যবহৃত একটি লবণ। এটি শৈবালের উৎপাদন বন্ধে খুব কার্যকরী।
শিল্প-কারখানায় লবণ
শিল্প-কারখানার নানা কাজে খাবার লবণ অপরিহার্য। যেমন: চামড়াশিল্পে চামড়ার ট্যানিং করতে, মাখন ও পনিরের শিল্পোৎপাদনে, কাপড় কাচার সোডা ও খাবার সোডা তৈরি করতে, সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইডের তড়িৎ বিশ্লেষণ ইত্যাদি কাজে খাবার লবণ ব্যবহৃত হয়। বেশ কিছু লৰণ যেমন: হুঁতে (CuSO4), মারকিউরিক সালফেট (HgSO4), সিলভার সালফেট (Ag2SO4) শিল্প-কারখানায় প্ৰভাৰক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
টেক্সটাইল ও রং তৈরির কারখানার রং ফিক্স করার কাজে লবণ প্রয়োজন হয়। ধাতুর বিশুদ্ধকরণে লবণ লাগে। রাবার প্রস্তুতিতে লবণ ব্যবহার করে রাবারকে (ল্যাটেক্স) রাবার গাছের নির্যাস থেকে আলাদা করা হয়। ঔষধ কারখানায় স্যালাইন এবং অন্যান্য ঔষধেও লবণ ব্যবহৃত হয়। ডিটারেন্ট তৈরিতেও ফিলার হিসেবে লবণ খুবই প্রয়োজনীয়।কাজেই দেখা যাচ্ছে যে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কৃষিতে, শিল্প-কারখানায় লবণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।না,
দলগত কাজ
কাজ: ধাতু ও এসিড থেকে লবণ তৈরি (চিত্র ৭.১৩)।
এই পরীক্ষাটি তোমাদের স্কুলের ল্যাবরেটরিতে শিক্ষকের উপস্থিতিতে করা বাঞ্ছনীয়।প্রয়োজনীয় উপকরণ: একটি ধাতু (যেমন: Mg), পাতলা হাইড্রোক্লোরিক এসিড, একটি বিকার, চামচ, ফানেল, ১টি পাত্র, ত্রিপদী স্ট্যান্ড, স্পিরিট ল্যাম্প বা বার্নার, অ্যাপ্রোন ।
পদ্ধতি: অ্যাপ্রোন পরে নাও। বিকারে ৫০ মিলিলিটার পাতলা হাইড্রোক্লোরিক এসিড নাও। এবার ৫-১০ গ্রাম ম্যাগনেসিয়াম রিবন (সরু ভার) বা ভার গুঁড়া চামচ দিয়ে বিকারে যোগ করে। কোনো বুদবুদ উঠছে কি? না উঠলে হালকা তাপ দাও। দেখবে বুদবুদ উঠতে শুরু করবে। বুদবুদ উঠা শেষ হলে আরো কিছু ম্যাগনেসিয়াম যোগ কর। তাপ দেয়ার পরও বুদবুদ না উঠলে বুঝতে হবে এসিড পুরোপুরি বিক্রিয়া করে ফেলেছে এবং আর কোনো এসিড বিকারে অবশিষ্ট নেই। এভাবে সমস্ত এসিড বিক্রিয়া না করা পর্যন্ত অল্প অল্প করে ম্যাগনেসিয়াম রিবন (সরু তার) বা গুঁড়া যোগ করতে থাক। এবারে ফানেল ও ফিল্টার কাগজের সাহায্যে অতিরি ম্যাগনেসিয়াম মিশ্রণ থেকে আলাদা কর। প্রাপ্ত দ্রবণকে ত্রিপদী স্ট্যান্ডের উপর বসিয়ে স্পিরিট ল্যাম্প দিয়ে তাপ দিতে থাক, যতক্ষণ পর্যন্ত না পাত্রের পায়ে লবণের ছোট ছোট দানা দেখা যায়। এবাবে তাপ দেওয়া বন্ধ করে পাত্রটিকে ঠাণ্ডা কর। পাত্রের তলায় বা গায়ে দানাদার বস্তু কী পেয়েছ? এটি হলো ম্যাগনেসিয়াম ক্লোরাইড লবণ। এখানে ম্যাগনেসিয়াম হাইড্রোক্লোরিক এসিডের সাথে বিক্রিয়া করে MgCl2 ও H2 গ্যাস উৎপন্ন করেছে। এই হাইড্রোজেন গ্যাসের কারণেই আমরা বিকার থেকে বুদবুদ উঠতে দেখি। MgCl2 পানিতে দ্রবীভূত ছিল পানি বাষ্পীভূত করে আমরা লবণটি আলাদা করতে পেরেছি।
Read more